কেন্দ্র থেকে মাঠ প্রশাসন এখনো গতিহীন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পৌনে তিন মাস চলে গেলেও এখনো গতিহীন গোটা প্রশাসন। প্রশাসনযন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয় থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনে সামগ্রিকভাবে চলছে এক ধরনের দায়সারা গোছের কার্যক্রম। ঘন ঘন বদলি, নিয়োগ দিয়ে কয়েক ঘণ্টা পর তা বাতিল, আটটি করে সচিব ও জেলা প্রশাসকসহ (ডিসি) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ দিনের পর দিন শূন্য থাকার কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া আগের সরকারের যারা কর্মরত তাদের ওপর নীতিনির্ধরকদের এক ধরনের আস্থাহীনতা আছে। আর কখন চাকরি চলে যায়-এমন আশঙ্কা থেকেও ওইসব কর্মকর্তা (আগের সরকারের সময় পদায়ন) কাজকর্মে পুরোদমে মনোসংযোগ করতে পারছেন না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারের যাবতীয় কাজের স্বাভাবিক গতি চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু শাখার কর্মকর্তা পদে একাধিকবার রদবদল করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার একান্ত সচিব (পিএস) নিয়োগ দিয়ে একদিনের মাথায় তা বাতিল করা হয়েছে। এর আগে খাদ্য ও নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সচিব নিয়োগ দিয়েও যথাক্রমে এক ও তিন দিনের মধ্যে তা বাতিল করা হয়েছে। একটি মন্ত্রণালয়ে সচিব নেই, এর অধীনস্থ অধিদপ্তর ও সংস্থায় নেই মহাপরিচালক (ডিজি) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)।
এসব বিষয়ে মন্তব্য নিতে শনিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস-উর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরে বিষয়বস্তু লিখে প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে এসএমএস করা হয়। সন্ধ্যা ৬টা ৫৮ মিনিটে তিনি এসএমএসের জবাব দেন। সেখানে লেখেন-‘অশেষ ধন্যবাদ পরে কথা বলি।’
জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসনে উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। সচিবের পদ শূন্য থাকার কোনো কারণ নেই। জরুরি ভিত্তিতে সচিব নিয়োগ হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। পোস্টিং দিয়ে আবার সরিয়ে দেওয়া এটা এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা। এসব বিষয় দায়িত্বশীলদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রশাসন পরিচালনায় সরকারের কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। ভালো হলেও আমার পছন্দ হয় না-তাই তাকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এটাই চলছে।
তিনি আরও বলেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারে দায়িত্বশীলদের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। কে কোথায় কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা পরিষ্কার নয়। কাউকে কোথাও নিয়োগ দিয়ে আবার সরিয়ে দেওয়া হলে গোটা প্রশাসনে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়। এতে প্রশাসন অকার্যকর হয়ে যায়। সচিব, মহাপরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক না থাকা মানে জনসেবা বিঘ্নিত হয়। আর ডিসিরা সরাসরি জনসেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই ডিসি পদ শূন্য রাখা মানে মানুষকে সেবা বঞ্চিত করা। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে উপায় কী-জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেসব আমলা প্রকৃত অর্থেই প্রশাসন বোঝেন, তাদের জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে অন্যকিছু বিবেচনা করার সুযোগ নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগে এপিডি (অতিরিক্ত সচিব) হিসাবে মো. আব্দুর রউফকে পদায়ন করা হয়। একই অনুবিভাগের মাঠ প্রশাসন অধিশাখায় যুগ্মসচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয় কেএম আলী আজমকে। ডিসি নিয়োগে অনিয়ম ও হট্টগোলে জড়িয়ে পড়ায় তাকে সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার হিসাবে বদলি করা হয়। পদটি দীর্ঘদিন শূন্য থাকার পর নতুন করে যুগ্মসচিব রাহিমা আক্তারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ৫ আগস্টের পর এই অনুবিভাগের পদোন্নতি অধিশাখায় যুগ্মসচিব পদে ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদকে নিয়োগ দেওয়া হয়। জিয়াউদ্দিনের বিরুদ্ধে ডিসি নিয়োগের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তাকে বিপিএটিসিতে বদলি করা হয়। অবশ্য পরে তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। তার ওই পদে বর্তমানে যুগ্মসচিব ড. মো. গোলাম আজমকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে তিন মাসে দুজন কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এপিডি অনুবিভাগের ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-১ শাখায় ৫ আগস্টের পর নিয়োগ দেওয়া হয় উপসচিব মিঞা মুহাম্মদ আশরাফ রেজা ফরিদীকে। ১৫ দিনের মাথায় তাকে বদলি করে সচিবালয়ের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নিয়োগ দেওয়া হয় উপসচিব মো. আলমগীর কবিরকে। এক মাসের মাথায় তাকে সরিয়ে দিয়ে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে উপসচিব জামিলা শবনমকে। এই একটি পদে তিন মাসে তিনজন কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়েছে। এপিডি অনুবিভাগের ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-২ শাখায় ৫ আগস্টের পর উপসচিব মো. শরীফুল আলমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার নিয়োগের এক মাসের মাথায় তাকে সরিয়ে দিয়ে উপসচিব মিঞা মুহাম্মদ আশরাফ রেজা ফরিদীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৫ আগস্টের পর একই ডেস্কে দুবার করে অফিসার বদল করা হয়েছে। এপিডি অনুবিভাগের মাঠ প্রশাসন-২ অধিশাখায় ৫ আগস্টের পর নিয়োগ দেওয়া হয় উপসচিব হুসনা আফরোজকে। তিনি জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয় উপসচিব মো. ইব্রাহীমকে। মাঠ প্রশাসন অধিশাখা-১ অধিশাখায় ৫ আগস্টের পর নিয়োগ দেওয়া হয় উপসচিব মর্তুজা আল মুয়ীদকে। এক মাসের মাথায় আবার তাকে সরিয়ে দিয়ে আবু সালেহ মো. মাহফুজুল আলমকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একান্ত সচিব হিসাবে গত ২২ অক্টোবর নিয়োগ দেওয়া হয় পেশাদার কূটনীতিক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হককে। নিয়োগের একদিনের মাথায় তার নিয়োগ আদেশ বাতিল করা হয়। উল্লেখ্য, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক বর্তমানে বেইজিংয়ের বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার ও ডেপুটি চিফ অব মিশন হিসাবে কর্মরত।
বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কোনো সচিব নেই। কারণ সচিব ইসমাইল হোসেন এনডিসিকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। ফলে সচিব পদ শূন্য। মন্ত্রণালয়টির অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তরে কোনো ডিজি নেই এক মাসেরও বেশি সময় ধরে। কারণ সাবেক ডিজিকে ওএসডি করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনেও নেই কোনো ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। এমডিকে নানা অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ওএসডি করা হয়েছে। ফলে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর এবং ফাউন্ডেশন অভিভাবকশূন্য। এমন বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে চলছে তা সহজেই অনুমেয়।
ইতোপূর্বে খাদ্য ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা এলাহী দাদ খানকে দুবছরের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ সে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছাত্রলীগের ছেলেমেয়েদের চাকরি দিতে গিয়ে পরীক্ষার নম্বর টেম্পারিংয়ে ধরা খেয়েছেন এলাহী দাদ খান। ঘটনা জানাজানি হলে তার নিয়োগ আদেশ জারির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা নিয়োগ বাতিল করা হয়। একই দিনে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান এএসএম মতিউর রহমানকে নৌপরিবহণ সচিব হিসাবে নিয়োগ দিয়ে তিন দিনের মাথায় নিয়োগ বাতিল করা হয়। কারণ তিনি গত এক বছরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনটি কবিতার বই লিখেছেন।
বর্তমানে নৌপরিবহণ, সমাজকল্যাণ এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কোনো সচিব নেই। এছাড়া পরিকল্পনা বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, সুরক্ষা সেবা বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার বিভাগে কোনো সচিব নেই। পরিকল্পনা কমিশনে সচিব পদমর্যাদায় একজন সদস্যের পদ ফাঁকা রয়েছে। নৌপরিবহণ সচিবকে ওএসডি করা হয়েছে। পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব এবং পরিকল্পনা বিভাগের সচিব পদমর্যাদায় একজন সদস্যকে ওএসডি করা হয়েছে।
এখনো আট জেলায় ডিসি নেই। জেলাগুলো হলো-রাজশাহী, নাটোর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও দিনাজপুর। প্রায় দেড় মাস ধরে এ পদগুলো ফাঁকা।