সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক পরিবহণ সেক্টরের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে ছিল স্ত্রীর।
পরিবহণে চাঁদাবাজি, জমি দখল, অবৈধ বালু ব্যবসা আর সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। পালিত চাঁদাবাজদের দিয়ে স্ত্রী নিয়ন্ত্রণ করতেন পরিবহণ সেক্টরের চাঁদাবাজি। আর সন্তান হাল ধরেছিলেন অবৈধ বালু ব্যবসার। এলাকার জমি দখল করতে ছাত্রলীগ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সন্ত্রাসী বাহিনী।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মানিকগঞ্জ-৩ আসনে (সদর ও সাটুরিয়া উপজেলা) চারবারের সংসদ-সদস্য জাহিদ মালেক (স্বপন) ২০০৮ সালে প্রথম সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। একবার স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী এবং পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার পরই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন জাহিদ মালেক ও তার অনুসারীরা। রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে এলাকায় গড়ে তোলেন ত্রাসের রাজত্ব। জাহিদ মালেকের ক্ষমতার দাপটে স্ত্রী শাবানা মালেক হয়ে উঠেন অর্থলোভী। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তিনি নিজে গড়ে তোলেন পরিবহণ চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট। প্রথমে মানিকগঞ্জ জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি বাবুল সরকারকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব দেন শাবানা মালেক। প্রতিদিন পরিবহণ সেক্টর থেকে চাঁদাবাজির ১ লাখ টাকা তাকে দিতে হতো। একপর্যায়ে চাঁদাবাজি নিয়ে বাবুল সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তিনি পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলামকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব দেন। এছাড়া ক্ষমতাবলে একাধিক স্কুলের সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন শাবানা।
অন্যদিকে বাবার প্রতাপে ছেলে রাহাত মালেক শুভ্র এলাকায় গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। দুই ভাই জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সিফাত কৌরাইশি সুমন ও ইরাদ কৌরাইশি ইমনের মাধ্যমে জেলায় আধিপত্য বিস্তার করেন রাহাত। দখল করে নেন এলাকার অবৈধ বালু ব্যবসা। সেই সঙ্গে দখল করেন সাধারণ মানুষের জমি। সরকারি হাসপাতালে আধিপত্য বিস্তার করে চাকরি বাণিজ্য শুরু করেন রাহাত।
অভিযোগ রয়েছে, জাহিদ মালেক আত্মীয়স্বজন দিয়ে মানিকগঞ্জ সদর এবং সাটুরিয়া উপজেলায় গড়ে তোলেন রাক্ষসী সিন্ডিকেট। এর নেতৃত্বে ছিলেন তার ফুপাতো ভাই মানিকগঞ্জ সদর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইসরাফিল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আফসার উদ্দিন সরকার, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক খান তুষার, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক সুলতানুল আজম খান আপেল, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম, জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি বাবুল সরকার, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সিফাত কৌরাইশি সুমন, ইরাদ কোরাইশি ইমন, সাটুরিয়ার হরগজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার ইসলাম জ্যোতি খান, সাটুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আফাজ উদ্দিন। তাদের মাধ্যমে দুই উপজেলায় দুর্নীতির রাজত্ব চালান জাহিদ মালেক। আওয়ামী লীগের ১৬ বছরে জাহিদ মালেক পোষা সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে অবৈধভাবে জমি দখল, বালুমহাল, পরিবহণে চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাণিজ্য করে দেশে-বিদেশি গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। মানিকগঞ্জের গড়পাড় গ্রামে তিনি গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, ছেলের নামে শুভ্র সেন্টার, খামার বাড়ি, মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে কর্নেল মালেক টাওয়ার, জাগীর শিল্প অঞ্চলে কার্বন হোল্ডিংস লিমিটেড নামের কারখানা, সাটুরিয়ার নাহার গার্ডেন এলাকায় বিশাল কাঁচামালের আড়ত, জাগীর ইউনিয়নের ঢাকুলীতে ৩১ বিঘা জমিও তার কবজায়। এ জমি তিনি এসেনশিয়াল ড্রাগের কাছে দুর্নীতির মাধ্যমে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। জাহিদ মালেক ফুপাতো ভাই ইসরাফিল হোসেনকে দুইবার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। তার মাধ্যমে তিনি অবৈধ বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেছেন, জাহিদ মালেক ও তার পরিবারের সদস্যরা এলাকায় শত শত বিঘা জমির মালিক হয়েছেন। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এসব জমি জোরপূর্বক বা নামমাত্র মূল্যে লিখে নিয়েছেন। জমি লিখে না দিলে তাদের নামে মিথ্যা মামলাসহ হয়রানি করা হতো বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ঢাকুলি গ্রামে সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগসের কারখানা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন জাহিদ মালেক। এজন্য কেনা হয়েছিল সাড়ে ৩১ একর জমি। এসব জমির বেশির ভাগ জাহিদ মালেক নিজের প্রতিষ্ঠান এবং ছেলেমেয়ের নামে জোর করে লিখে নিয়েছিলেন। এরপর কৃষিজমিতে মাটি ভরাট করে মৌজা মূল্য বাড়ানোর চেষ্টা করেন। যাতে সরকার জমি অধিগ্রহণ করলে চড়া মূল্য পাওয়া যায়। অন্যদিকে গড়পাড়া ঘোষের বাজার এলাকায় বিশাল বাগানবাড়ি করেছেন জাহিদ মালেক। অভিযোগ আছে, সেখানে মায়ের নামে স্কুল করার কথা বলে স্থানীয়দের চাপ দিয়ে জমি নিয়েছেন। তার ক্ষমতার দাপটের কাছে অসহায় ছিলেন এলাকার মানুষ। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে ১০তলা বাণিজ্যিক ভবন, বিশাল বাগানবাড়ি, সভা-সেমিনারের জন্য ছেলের নামে ‘শুভ্র সেন্টার’, বনানীতে ১৪তলা বিটিএ টাওয়ার, ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, প্লটসহ ১৬ বছরে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন জাহিদ মালেক। হলফনামায় দেখা গেছে, ২০০৮ সালে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকা পর্যন্ত জাহিদ মালেকের সম্পদ বেড়েছে ১১ গুণ।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ফুপাতো ভাইয়ের ছেলে তন্ময়কে চাকরি দেওয়া হয়েছে এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানিতে। এছাড়া সাটুরিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তানভীর খান মুহিতকে এসেনশিয়াল ড্রাগে চাকরি দিয়েছেন জাহিদ মালেক। এমনকি বর্তমান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুরকেও এসেনশিয়াল ড্রাগে চাকরি দিয়েছেন মন্ত্রীপুত্র। সাটুরিয়া উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি মাসুদ খান জুম্মার মেয়ের জামাইকে কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকরি দিয়েছেন রাহাত মালেক।
মানিকগঞ্জ-৩ আসন থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচনে জাহিদ মালেকের বিপক্ষে প্রার্থী হয়ে অত্যাচারের শিকার হন ড. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিগত ১০ বছর জাহিদ মালেক আমাকে কমপক্ষে ৬ বার আঘাত করেছেন। তার পোষা ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে আমাকে একবার অপহরণ করে জাহিদ মালেকের বাড়িতে নিয়ে মারধর করা হয়। এরপর গত জাতীয় নির্বাচনের আগে সাটুরিয়া বাজারে আমাকে মারধর করে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন এবং তার ভাই ইমন। আমাকে জোর করে থানায় নিয়ে মিথ্যা মামলাও দিতে চেয়েছিল। তখন জাহিদ মালেকের নির্দেশে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আফসার উদ্দিন এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক সুলতানুল আজম খান আপেল আমাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে মুচলেকা নেন। আমি যেন কোনোদিন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করি এবং দলে কোনো ধরনের পদ-পদবি না গ্রহণ করি।
একই রকম অভিযোগ করে সাইদুর রহমান খান হাবিল বলেন, জাহিদ মালেক জোর করে আমাদের ৫ শতাংশ জমি দখল করে মানিকগঞ্জের বাসস্ট্যান্ডে ১০তলা ভবন নির্মাণ করেছেন। এই জমির জন্য আমার বড় ভাইকে তার ক্যাডার বাহিনীর তুষার, বাবুল সরকার ওরফে কানা বাবুল, জাহিদ জজকোর্ট এলাকায় মারধর করে। জাহিদ মালেকের নির্দেশে তার সন্ত্রাসী বাহিনী তুষার বাবুল সরকার আর জাহিদ আমাদের ভবন ভেঙে জায়গা দখল করে নেয়। এই শোকে আমার বড় ভাই স্ট্রোক করে এখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। ভুক্তভোগী কৃষক আব্দুস সালাম জানান, তার গভীর নলকূপের আওতায় ১১০ বিঘা কৃষিজমি জোর করে ভরাটের পর নামমাত্র মূল্য দিয়েছেন সাবেক মন্ত্রী। ৯২ শতাংশ জমির কোনো টাকাই দেননি। কিছু বললেই তার লোকজন ভয়ভীতি দেখাত। আরেক ভুক্তভোগী ইউনুছ আলী জানান, চারপাশে বাঁধ দিয়ে মাঝখানে তার জমি আটকে ফেলেছিল। এরপর লিখে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। পরে বাধ্য হয়ে বিক্রি করে দেন। কিন্তু জমির দাম লাখ টাকা শতাংশ হলেও তাকে মাত্র ৪০ হাজার টাকা শতাংশ হিসাবে টাকা দেওয়া হয়েছে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগেই সপরিবারে ব্যাংকক পালিয়ে যান। এদিকে আত্মগোপনে আছেন তার বাহিনীর সদস্যসহ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও। তাই দুর্নীতির এসব বিষয়ে কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। মানিকগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও যুবদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ রফি (অপু) বলেন, জাহিদ মালেক ১৫ বছরে মানিকগঞ্জে কোনো উন্নয়ন করেননি। সরকারি বরাদ্দ এনে কেবল নিজে এবং স্বজনদের পকেট ভারী করেছেন। তিনি এবং তার স্বজনরা ১৫ বছরে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই স্বাস্থ্যমন্ত্রী মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে পরিবহণ খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বাণিজ্য করেছেন। একক আধিপত্য বিস্তার করে অবৈধ বালু, মানুষের জমি দখল করতে গড়েছিলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। জাহিদ মালেকের অত্যাচারে মানিকগঞ্জবাসী অতিষ্ঠ ছিল। তার অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তাকে আইনের আওতায় আনা হোক।