ধর্ম নয়, যে কারণে রাহুল আনন্দের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়
পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে তৈরি হয় নতুন সংকট। বিভিন্ন স্থানে করা হয় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। সেদিন ঘর পুড়েছে জনপ্রিয় ব্যান্ড জলের গানের প্রধান রাহুল আনন্দের। ভারতীয় কয়েকটি গণমাধ্যমসহ ফেসবুকে রাহুলের বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার শুরু করে।
তবে অবশেষে সামনে আসে আসল ঘটনা। গত ৯ আগস্ট ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন ফ্যাশন হাউস খুঁতের অন্যতম স্বত্বাধিকারী ফারহানা হামিদ।
তার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘রাহুল আনন্দের বাসা উদ্দেশ্য করে আগুন দেয়া,লুটপাট বা ভাংচুর করা হয়নি। আগুন দেয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ৩২ এর বর্তমান বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম ও তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ।
রাহুলদা একটা একতলা বাসায় ভাড়া থাকতেন। একপাশে তাদের সংসার, অন্য পাশে জলের গানের স্টুডিও (অনেকের ভিডিওতে এই বাসাটা নিয়ে ভুলভাল কথা বলতে দেখেছি আমি)। সেই বাড়িটা ব্যক্তিমালিকানায় ছিলো। ৩২ এর সেখানে আরো অনেক এমন বাসা আছে। রাহুলদা ও তার পরিবারের দুর্ভাগ্য এই মায়াময় বাসাটা নতুন মিউজিয়াম এর দেয়াল ঘেষে এবং সান্তুরের পিছনে ছিলো, তাই তার বাসাতেও আগুন দেয়া হয়। রাহুলদাকে উদ্দেশ্য করে আগুন দিলে তারা এই পরিবারকে এভাবে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতো না। আর সুযোগ না দিলে সেই বাসা থেকে বের হওয়া অসম্ভব।
রাহুলদার বাসায় আগুনের সাথে ধর্ম, বর্ণ,জাত, সংস্কৃতি এর কোনো সম্পর্ক নেই। তাই এমন গুজব না ছড়ানোর অনুরোধ করছি। দেশ এর এই পরিস্থিতিতে যে কোনো গুজব ভয়াবহ রুপ নিতে পারে। আমরা সচেতন হই। একটা সংসার, একটা দলের বহুদিনের সাধনা, একজন বাচ্চার শৈশব এর সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। আর কারো কোন কিছু পুড়ে না যাক। ভালোবাসা নেমে আসুক মানুষের মনে, আপনারা তাদের পাশে থাকলে আবার ‘জলের গান’র সাথে গলা মিলিয়ে গান গাইবো-‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।’
জলের গানের প্রতিটা বাদ্যযন্ত্র দীর্ঘ সময় নিয়ে হাতে বানানো এবং প্রায় সকলের চেনা। কোথাও কেউ কোন কারণে খুঁজে পেলে তা ফেরত দেয়ার অনুরোধ করছি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে কোথাও আগুন দেয়ার পক্ষেই না। বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম এর মতো দেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসে আগুন দেয়ার পক্ষে তো অবশ্যই না। এই সময়ে সংখ্যালঘুর উপর আক্রমণ এর বিষয়ে আমি অবগত এবং এর ঘোর বিপক্ষে। কিন্তু রাহুলদার বাসায় আগুন ধর্ম, বর্ণ,জাত, সংস্কৃতি এর কারনে দেয়া হয় নাই। তবে এমন গুজব ছড়াচ্ছে যে ধর্ম, বর্ণ,জাত, সংস্কৃতি কারনে আগুন দেয়া হয়েছে। এমন গুজব না ছড়াই।’
সেই সঙ্গে রাহুল আনন্দের স্ত্রী উর্মিলা শুকলার একটি পোস্ট তুলে ধরা হয়। সেটিও তুলে ধরা হলো-
‘বাইরে জনতার বিজয় মিছিলের চিৎকার। হঠাৎ দেখলাম পিছনের সবগুলো বাড়িতে আগুন। আমরা মুহূর্তেই দিশেহারা হয়ে পড়লাম। বুঝলাম ৩২ এর সবগুলো বাড়িতেই আগুন লাগানো হয়েছে। আমাদের বাড়িটা সান্তুর রেষ্টুরেন্টের পিছনে। পাশে আমাদের বাড়িওয়ালা জনাব আইনুল হক-এর তিনতলা বাড়ি,সেখানে প্রথম ভাঙচুর হয় ও আগুন দেয়। যখন সান্তুরের গেইট দিয়ে উল্লাসে জনতা ঢুকে পড়েছে আর সান্তুরে আগুন ধরাচ্ছে তখন আমরা বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। আমার যে ঘরভর্তি বাদ্যযন্ত্র। তাদেরকে বুঝানোর জন্য এগিয়ে গেলাম পরিবারের সবাই। তারা তখন ৩২ ধ্বংসের উল্লাসে কোনো কিছুই শোনার চেষ্টা করেনি। তবে কিছু মানুষ এগিয়ে এসেছিলো….তারা চেয়েছিলো অন্যদের বুঝাতে…কেউ কারো কথা শোনার মতো অবস্থায় ছিলো না। একজন বললো- ১৪ বছরের রাগ…এই এলাকা ধ্বংস করবেই।..বরং আপনাদের কে আমরা সাবধানে বের করে দিচ্ছি… আপনারা এখান থেকে চলে যান। ৩২ ধ্বংস করার উন্মাদনায় আমার ঘর পুড়ে গিয়েছে। শুধু আমার নয় আমাদের বাড়ির মালিকের ঘরও পুড়েছে। আশপাশের আরো কিছু বাড়ি ঘরও পুড়েছে। আর কারো কোন ক্ষতি না হোক।
আমি অনেকবার কিছু লিখতে চেয়েছি…. কিন্তু কান্নায় আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে….আমি কোনো কিছু বলার মতো অবস্থায় নাই… তারা কেউ নির্দিষ্ট করে আমাদের বাড়ি পুড়াতে চায়নি…চেয়েছে ৩২ এর এই বাড়িগুলো ধ্বংস করতে। আমাদের তো সব গেছে, মানসিক ভাবে আমরা বিধ্বস্ত… আমাদের বাস্তবতা আশাকরি সবাই বুঝবেন। বাংলাদেশ সুন্দর হোক। সুন্দর হোক আগামীর পথচলা। আমরা সবাই মিলেই বাংলাদেশ।’
‘রাহুলদার বাসায় আগুনের সঙ্গে তাঁর ধর্ম, বর্ণ, জাত, সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। এমন গুজব না ছড়ানোর অনুরোধ করছি।’
ঘটনাটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা ছড়িয়েছে ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যম। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের চিত্র হিসেবে তুলে ধরা হয় রাহুলের বাড়ির অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।